চন্দ্রাবতী শিবমন্দির,নীলগঞ্জ,কিশোরগঞ্জ


কিশোরগঞ্জ এর কন্যা কবি চন্দ্রাবতী বাংলার আদি নারী কবি। “মৈমনসিংহ গীতিকা” অনুযায়ী (জন্ম:১৫৫০খ্রি:-মৃত্যু:১৬০০খ্রি:) সালের দিকে খরস্রোতা ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইঝখাপন ইউনিয়নের পাতুয়াইল গ্রামে (মতান্তরে বর্তমান কাচারিপাড়া গ্রামে) চন্দ্রাবতী জন্মগ্রহণ করেন।এখানেই চন্দ্রাবতীর স্মৃতি বিজরিত মনোরম দুইটি মন্দির আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। “মনসা মঙ্গল কাব্য” এর রচয়িতা পন্ডিত দ্বিজবংশী দাস এবং সুলোচনার কন্যা কবি চন্দ্রাবতির জন্ম কথা চন্দ্রবতী-পালায় বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

“ ধারাস্রোতা ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়
বসতি যাদবান্দব করেন তথায়।
ভট্টাচার্য্য ঘরে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী
বাঁশের পাল্লায় তাল পাতার ছাউনি।
ঘট বশাইয়া সদা পূজে মনসায়
কূপ করি সেই হেতু লক্ষী ছাড়ি যায়।
দ্বিজবংশী বড় হৈল মনসার বরে
ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে। ” (সংক্ষেপিত)

চন্দ্রাবতী শিবমন্দির০১

কবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের এক ট্রাজিক নায়িকা। রোমান্টিক মনের অধিকারী কবি চন্দ্রাবতীর জীবনে ঘটে যায় এক প্রেমের বিয়োগান্তক অধ্যায়। নয়ানচাঁদ ঘোষের বর্ণনায় আছে, চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বাল্য সখা জয়ানন্দের সাথে বন্ধুত্ব গভীর প্রেমে পরিণত হয়।দুই পরিবারের সম্মতিতেই জয়ানন্দ ও চন্দ্রবতীর বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে যায় এক নাটকীয় ঘটনা। বাল্য প্রেমকে পদ-দলিত করে চঞ্চল মতি জয়ানন্দ ত্রিভুজ প্রেমের জালে জরিয়ে পড়ে। যেই সন্ধ্যায় চন্দ্রাবতী বিবাহ বেশে অপেক্ষমান সেই সন্ধ্যায় খবর আশে আসমানী মতান্তরে কমলা নামের এক মুসলমান মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে তাকেই বিয়ে করে। এই নিদারুন সংবাদে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে চন্দ্রাবতীর হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যায়। স্তম্ভিত চন্দ্রাবতী নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেন। প্রচন্ড আঘাতে মুষড়ে পড়া কন্যাকে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেন পিতা দ্বিজবংশী দাস। তিনি কন্যাকে এক মনে শিবের নাম যপ করতে এবং রামায়ণ রচনায় মনোনিবেশ করতে পরামর্শ দেন। ”চন্দ্রাবতী পালায়” এ ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আছে এভাবে-

“অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে
শিব পূজা কর আর লেখ রামায়ণে”

অনুতপ্ত জয়ানন্দের মোহ কেটে গেলে পুন:রায় চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসলে চন্দ্রবতী তাকে প্রত্যাক্ষন করিলে সন্ধ্যা মালতী ফুল দিয়ে মন্দিরেরর দরজায় চার ছত্রের একটি পত্র লিখে সে স্থান ত্যাগ করে।জয়ানন্দের পত্রটি ছিল এই –

“ শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।
পাপিষ্ট জানিয়ো মোরে না হইল সম্মত
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত। ”

চন্দ্রাবতী শিবমন্দির০২

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পূজা শেষে মন্দিরের দরজা খুলে চন্দ্রাবতী মন্দিরের লেখাটি দেখতে পেয়ে মন্দির অপবিত্র হয়েছে ভেবে মন্দির গায়ের সেই লেখা মুছে ফেলার জন্য তিনি নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন, নদীর জলে ভাসছে জয়ানন্দের মৃত দেহ।মুহুর্তের মধ্যে তীব্র অনুশোচনায় ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাপিয়ে পড়েন কবি চন্দ্রাবতী। আর শেষ যাত্রার সঙ্গী হন জয়ানন্দের।চন্দ্রাবতীর জীবনাবসানের ফলে রামায়ন রচনার কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। সেই অসমাপ্ত রামায়ন এখনও ভারতের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুতি শালায় সংরক্ষিত অবস্থায় বাংলার আদি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতি বহন করছে।

 

দারিদ্র্য ক্লীষ্ট পরিবারে জন্ম গ্রহন করেও কবি চন্দ্রাবতী মধ্যযুগের কাব্য সাহিত্যে অনন্য অবদান রেখে গেছেন।চন্দ্রাবতীর কবিতা থেকে তার পিতামহের নাম যাদবান্দব,পিতার নাম দ্বিজবংশী দাস এবং মাতার নাম সুলোচনা বলে জানা যায়।সময়ের পরিক্রমায় চন্দ্রাবতীর অধ্বস্তন পুরুষ নীলকন্ঠ রায়ের বাড়ি নামে পরিচিত কাচারিপাড়া গ্রামের বর্তমান ভগ্নপ্রায় ভবনটি কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

 

জমিদার নীলকন্ঠ রায়ের বাড়ির সন্মুখ অংশ

জমিদার নীলকন্ঠ রায়ের বাড়ির পশ্চাদ অংশ

যাতায়াত ব্যবস্থা: কিশোরগঞ্জ সদর থানার গাইটাল বাসস্ট্যান্ড হতে সিনজি বা অটোগাড়ি যোগে নীলগঞ্জ যাত্রাপথে মাইঝখাপন ইউনিয়নের বর্তমান কাচারিপাড়া নামক স্থানে ইহার অবস্থান।

দূরত্ব: কিশোরগঞ্জ জেলা শহর হতে ০৫ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে।

অবাসিক ব্যবস্থা: উল্লেখিত স্থানে আবাসনের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তবে কিশোরগঞ্জ সদর পৌরসভায় গাংচিল, উজানভাটি, নিরালা, ক্যাসেল সালাম নামে চাইনিজ ও আবাসিক হোটেল এর ব্যবস্থা রয়েছ। অবস্থানঃ গৌরাঙ্গবাজার, কিশোরগঞ্জ।