সেন্টমার্টিন দ্বীপ, টেকনাফ, কক্সবাজার


বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজার। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত যার ট্রেডমার্ক। এই জেলারটেকনাফ উপজেলার মূল ভূখন্ড হতে প্রায় ১২-১৩ কিঃ মিঃ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এর বুকে লুকিয়ে আছে এক অনিন্দ সৌন্দর্য্য…. সেন্টমার্টিন, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। নারিকেল গাছের আধিক্যের কারনে নারিকেল জিন্জিরা নামে খ্যাত মাত্র আট বর্গকিলোমিটারের এ দ্বীপটিতে আলাদা করে বলার মতো কোন জায়গা নেই! কারন পুরো দ্বীপের প্রতি ইন্ঞ্চি জুড়েই পাবেন আলাদা সৌন্দর্য্য।পূর্বের জাহাজ ভেড়ার জেটি আর সূযোর্দয় পশ্চিম বীচের নির্জনতা,উত্তর দিককার নারকেল গাছের আধিক্য আর দক্ষিনে ছেড়া দ্বীপ আর সাথে উপকূলবর্তী জেলেদের মাছ ধরার কার্যক্রম।অপার সৌন্দর্র কথায় সেন্টমার্টিনে ঘুরতে আসতে চাইলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন দুই দিন সময় নিয়ে আসবার, যাতে পুরো দ্বীপটাই ভালোভাবে ঘুরে দেখা যায়। তবে সাধারনত এক রাত দুই দিন সময়ে ঘুরে দেখা সম্ভব দ্বীপের সব কিছু।

 

 

তবে গাংচিলের ওড়াওড়ি আর নাফ নদীর অপূর্ব সৌন্দর্য্যের কাছে সেটাকে কোন কষ্ট বলেই মনে হবে না নিশ্চিত। কোথায় থাকবেন: সেন্টমার্টিনে হোটেল ভাড়ার ক্ষেত্রে এখানেও বন্ধের দিন গুলো মাথায় রাখতে হবে। কারন সাধারন দিনগুলো তে হোটেলের যে ভাড়া, বন্ধের দিনগুলিতে তা খুব সহজেই তিন চার গুনের বেশী হয়ে যেতে পারে! তাই হোটেল ভাড়ার ক্ষেত্রে আপনার যাবার দিনটা খুবই জরুরী। যদি বন্ধের দিনগুলোয় যাবার প্ল্যান করেন তবে আগে হতেই হোটেল বুকিং দিয়ে যাবেন, আর যদি সপ্তাহের অন্য দিন যান তবে আগে হতে বুকিং দেবার প্রয়োজন নেই, বরং সেন্টমার্টিন পৌছে নিজেই দরদাম করে হোটেল ঠিক করাটাই শ্রেয়। জেটি হতে নেমেই আপনাকে পার হতে হকে একটি বাজার। এই এলাকার হোটেল গুলো তুলনামুলক কোলাহল পূর্ণ, একটু নির্জন জায়গায় হোটেল চাইলে অবশ্যই চলে যাবেন দ্বীপের পশ্চীমে, পশ্চিম বীচে।

 

 

সায়রী ইকো রিসোর্ট, নীল দিগন্তে, ব্লু লেগুন রিসোর্ট, কোরাল ভিউ রিসোর্ট এগুলোই মোটামুটি সেন্টমার্টিনের জনপ্রিয় হোটেল এবং রিসোর্ট। ভাড়া শুরু ১৫০০ হতে।এই রিসোর্ট গুলোর প্রতিটিই সমুদ্রের পাশেই অবস্থিত আর অল্প খরচে থাকতে চাইলে বাজার হতে রাস্তা দিয়ে সোজা সামনে এগিয়ে যান। দ্বীপের মাঝামাঝি এই জায়গায়তেই আপনি পেয়ে যাবেন কাঙ্খিত হোটেল গুলো। তবে এই হোটেল গুলো হতে সমুদ্র দেখতে আপনাকে পাঁচ দশ মিনিট হাটতে হবে। খাবার: সেন্টমার্টিন দ্বীপে খাবারের মূল্য অন্য যেকোন পর্যটন স্পটের চাইতে তুলনামূলক বেশী। রিসোর্ট গুলোর সাথেই রয়েছে তাদের নিজস্ব রেস্তোরা, এর বাইরে জেটি সংলগ্ন বাজারেই পাবেন অধিকাংশ খাবারের দোকান। তবে যেখানেই খান না কেনো, প্রতিটি হোটেলের সামনেই দেখবেন সাজানো আছে কোরাল, পোয়া, ইলিশ, রূপচাঁদা বা চিংড়ির মতো অসংখ্য সামুদ্রিক মাছ। আপনি পছন্দ করে দিলেই গরম গরম পরিবেশিত হবে সেগুলো। আর সেন্টমার্টিনে এসে অবশ্যই এখানকার বিখ্যাত ডাব খেতে ভুলবেন না, যদিও দামটা সাধারনের চাইকে বেশ চড়া।

 

 

শুটকি আর কার্মিজ আচারও পাবেন ভালো, তবে একই জিনিস কক্সবাজার হতে বেশী দামে এখানে কিনতে হবে আপনাকে। যা দেখবেন: আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সেন্টমার্টিনে এসে আলাদা করে বলবার মতো কোন বিষয় নেই। যাত্রার শুরুতেই নাফ নদীর অপূর্ব রূপ মুগ্ধ করতে বাধ্য আপনাকে। জাহাজ ছাড়বার পরেই আপনাকে সংগ দিতে হাজির হবে একঝাঁক গাংচিল! পুরো যাত্রা জুড়েই দেখতে পাবেন এদের। নাফ হতেই পানির সবুজাভ পরিষ্কার রং মনোযোগ টানতে বাধ্য, তবে যতই গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাবেন, রংয়ের গভীরতা ততই বাড়বে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি এসেই পেয়ে যাবেন একেবারে পরিষ্কার সবুজ পানি! দ্বীপের উত্তর বীচটিতে মানুষের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশী, তাই প্রকৃত নির্জনতা উপভোগ করতে চলে যেতে পেরেন পশ্চীম বীচে। আর এদিককার সারি সারি কেয়াবন ও পাবেন না উত্তর দিকটায়। সেন্টমার্টিনের ভোরের সূর্যদয়ের যেমন রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য, তেমনি প্রবালের মাঝে দেখা সূর্যাস্ত অন্য যেকোন সৈকত হতে একেবারেই আলাদা। স্বচ্ছ সবুজ পানির নিচে পরিষ্কার দেখতে পাবেন প্রবাল।

 

 

এখানকার মানুষদের প্রধান জীবীকা মাছ ধরা। তাই তাদের ট্রলারের প্রস্তুতি দেখতেও ভুলবেন না। তবে এ দ্বীপের বড় আকর্ষণটা লুকিয়ে আছে আরো দক্ষিনে… মূল দ্বীপ হতে অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায়…. ছেড়াদ্বীপ। দ্বীপে যাতায়ত ব্যবস্থা: দ্বীপে কারেন্টের কোন ব্যবস্থা নেই, যে কারনে সেন্টমার্টেন দ্বীপে নেই কোন মোটর বা তেল চালিত যানবাহন! দ্বীপটির আয়তন এতোই ছোট যে আপনি হেটেই পুরো দ্বীপ ৩-৪ ঘন্টায় চক্কর দিয়ে আসতে পারেন। যানবাহন হিসেবে একমাত্র মাধ্যম ভ্যান। সাধারনত ১২ টে হতে ৩ টা অর্থ্যাৎ জাহাজ আসা যাবার সময়টুকুতে ভ্যানের জন্য আপনাকে অস্বাভাবিক ভাড়া দিতে হবে। বাকি সময় জনপ্রতি ২০ টাকা হিসেবে চড়তে পারবেন ভ্যানএ। আর এর বাইরে দ্বীপে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় ঘন্টায় ৩০ টাকা হিসেবে। দ্বীপ চক্কর দিতে ভাড়া নিতে পারেন সাইকেল।

 

 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি: ১. সেন্টমার্টিনে ভ্রমনের ক্ষেত্রে আপনার ভ্রমন এর সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।যদি একটু বাজেটের ভেতরে ঘুরতে চান তবে অবশ্যই বন্ধের দিনগুলো পরিহার করুন। ২. সেন্টমার্টিনে বিদ্যুৎ এর কোন ব্যবস্থা নেই। হোটেল এবং রিসোর্টগুলো কাদের নিজস্ব জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সেবা দিয়ে থাকে। তাই কেবল কয়েকটি হোটেল বাদ দিয়ে বাকি সব হোটেলেই দিনের অধিকাংশ সময়ই কারেন্ট পাবেন না। তবে প্রত্যেক হোটেলই সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত কারেন্টের ব্যবস্থা রাখে। তাই মোবাইল চার্জ বা অন্যান্য যেকোন কাজের জন্যে এই সময়টা অবশ্যই মাথায় রাখবেন। ৩. দ্বীপ হিসেবে সেন্টমার্টিন একেবারেই নিরাপদ। তাই রাতের সময়টুকু বীচে অবস্থান করতে পারবেন ৪. শীপের আসা যাওয়ার সময়ের সাথে মিল রেখে সেন্টমার্টিনের হোটেল গুলোর চেকআউট টাইম ১১:৩০ টা এবং চেক ইন টাইম ১২:৩০ টা। তাই আপনার ফেরার সময় ৩টা হলেও আপনাকে ১২ টার আগেই হোটেল রুম ছাড়তে হবে। ভ্রমন পরিকল্পনায় ব্যাপরটি মাথায় রাখুন। ৫.এ দ্বীপের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে পুরো দ্বীপকে চারপাশ হতে ঘিরে রাখা প্রবাল প্রাচীর। ঘুরতে আসা পর্যটকদের অসচেতনতা এবং তাদের চাহিদার জন্য স্থানীয় মানুষদের প্রবাল আহরনের কারনে দ্বীপের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। তাই দ্বীপ হতে কোনরকম প্রবাল নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন না। আইনগত ভাবেও প্রবাল আহরন এবং বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এখন।

 

 

যেভাবে যাবেন: ঢাকা হতে: ঢাকা থেকে টেকনাফের সরাসরি বাস রয়েছে। মূলত ফকিরাপুল হতেই এসব বাস যাত্রা শুরু করলেও, সায়দাবাদ এবং যাত্রাবাড়ি হতেও পাওয়া যাবে বাস। বাস ভাড়া নন এসি- ৯০০ হতে ১০০০ এবং এসি ১৬০০ টাকা পড়বে। চট্টগ্রাম হতে: চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস হতে সরাসরি টেকনাফগামী বাস পাবেন।বাস রাত ১২:৫০ এ ছেড়ে গিয়ে সকাল ৬:৩০ এর দিকে টেকনাফ ঘাটে নামিয়ে দেবে। দিনের অন্য সময় দামপাড়া অথবা বহাদ্দারহাট টার্মিনাল হতে কক্সবাজারগামী অসংখ্য বাস পাবেন যেহেতু টেকনাফ হতে সমস্ত শিপ ই সকাল ৯টা হতে ৯:৩০ টার মধ্যে সেন্টমার্টনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় তাই সকাল ৯ টার আগেই আপনাকে টেকনাফ পৌছাতে হবে।এখানে সেন্টমার্টিন যাবার জন্য রয়েছে প্রায় পাঁচ ছয়টি শিপ। সবগুলো শিপ ই সকাল ৯টা হতে ৯:৩০ টার মধ্যে টেকনাফ ছেড়ে যায় এবং সেন্টমার্টিন হতে বিকেল ৩টা হতে ৩:৩০ টার ভেতরে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

 

 

তাই আপনার ভ্রমন পরিকল্পনাটি সেভাবেই করুন। বাস হতে নামার আগে অবশ্যই হেল্পারকে জানিয়ে দিবেন ঠিক কোন জাহাজের জেটিতে নামতে চান আপনি। কারন প্রতিটি জাহাজের জেটি আলাদা। জাহাজ: টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলো হলো কেয়ারী সিন্দাবাদ, কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন, বে ক্রুজ, এমভি পারিজাত, এল সি টি কুতুবদিয়া এবং গ্রীনলাইন। এর মধ্যে কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন এবং গ্রীনলাইন সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বলে ভাড়া বেশী। বাকি জাহাজ গুলোর টিকেটের মূল্য ক্লাস ভেদে ৫৫০ হতে ১০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক টিকিটেই যাওয়া এবং আসার ভাড়া যুক্ত। মনে রাখবেন সাগর উত্তাল থাকার কারনে প্রতি বছর মোটামুটি এপ্রিল হতে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই রুটে জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। তাই ওই সময়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমনের পরিকল্পনা করলে যাওয়া আসার একমাত্র মাধ্যম মাছের ট্রলার, খারাপ আবহাওয়ার জন্য যা একেবারেই উপযুক্ত নয়।

 

 

টিকেট বুকিং: বাসের টিকিট কাউন্টারে সরাসরি যোগাযোগ করেই পাবেন। আর শিপের টিকিটের জন্যেও ঢাকায় কিছু কাউন্টার আছে তাদের। এছাড়া ফোনেও বুক করা যায় টিকেট। বন্ধের দিনগুলো অর্থ্যাৎ শুক্র শনি এবং জাতীয় বন্ধের দিন গুলোতে ভ্রমনের পরিকল্পনা করলে টিকেট আগে বুক করে যাওয়াটাই বেটার। সপ্তাহের মাঝামাঝি গেলে তার প্রয়োজন পড়বে না, তবে আগে টিকেট না কাটলে ভালো বসার জায়গা না ও পেতে পারেন, শিপের পুরো সময়টা দাঁড়িয়ে যেতে হবে।